কার্ড পেমেন্টে এমডিআর কে দেবে? | Who Bears MDR in Card Payments?

কার্ড পেমেন্টে এমডিআর কে দেবে?


Merchant Discount Rate (MDR) অর্থাৎ মার্চেন্ট ডিসকাউন্ট রেট হচ্ছে এমন একটি অতিরিক্ত পেমেন্ট প্রসেসিং ফি, যা একজন বিক্রেতা (মার্চেন্ট) তার কাস্টমারের কাছ থেকে পেমেন্ট গ্রহণ করার পর ব্যাংক বা পেমেন্ট গেটওয়েকে প্রদান করতে বাধ্য থাকেন। যখন আমরা নগদের পরিবর্তে কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং কিংবা ডিজিটাল ওয়ালেটের মাধ্যমে কোনো মার্চেন্টকে পেমেন্ট করি, তখন সেই মার্চেন্টকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দিতে হয়—এটাই হচ্ছে MDR বা সেটেলমেন্ট ফি।

ই-কমার্স পেমেন্ট অথবা রিটেইল শপে POS মেশিন ব্যবহার করে পেমেন্ট গ্রহণের ক্ষেত্রে, এই ফি প্রদান বাধ্যতামূলক। সহজভাবে বললে, যখন আমরা কোনো পণ্য বা সেবা বাবদ কার্ড দিয়ে টাকা পরিশোধ করি, এবং সেই টাকা মার্চেন্ট তার ব্যাংক একাউন্টে ট্রান্সফার করেন, তখন ট্রান্সাকশন অ্যামাউন্টের উপর নির্ভর করে একটি নির্দিষ্ট হারে চার্জ কেটে রাখা হয়। সাধারণত এই চার্জ ১% থেকে শুরু করে ৩.৫% পর্যন্ত হতে পারে, যা ব্যাংক বা কার্ড টাইপ অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। এটিই এমডিআর বা সেটেলমেন্ট ফি নামে পরিচিত।


কার্ড পেমেন্টে এমডিআর কে দেবে?

এমডিআর (Merchant Discount Rate) মূলত মার্চেন্ট কর্তৃক প্রদানযোগ্য একটি ফি, যা ব্যাংক বা পেমেন্ট গেটওয়েকে দেওয়া হয় কার্ড পেমেন্ট গ্রহণের বিনিময়ে। Visa, Mastercard এবং AMEX-এর মতো সকল আন্তর্জাতিক কার্ড নেটওয়ার্কের নীতিমালায় পরিষ্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, এই চার্জ গ্রাহকের উপর আরোপ করা যাবে না। যদিও কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে স্থানীয় আইন বা নিয়ন্ত্রকের অনুমতির ভিত্তিতে ব্যতিক্রম থাকতে পারে, তবে সাধারণভাবে মার্চেন্টের পক্ষ থেকেই এই খরচ বহন করতে হয়।


বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ও অঞ্চলে খুচরা পণ্যের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চার্জ নেওয়া বা ডিজিটাল পেমেন্টে এমডিআর গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও এই নীতিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করার কথা, বাস্তবে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী প্রকাশ্যে পস অ্যাকুয়ারিং ব্যাংকের নিয়ম ভঙ্গ করে গ্রাহকের উপর অতিরিক্ত চার্জ আরোপ করে থাকেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর অকার্যকর নজরদারির কারণে এই অনৈতিক চর্চা অব্যাহত থাকে এবং ডিজিটাল পেমেন্ট গ্রহণে ভোক্তাদের আগ্রহ কমে যায়, যা একটি ক্যাশলেস সোসাইটি গঠনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশে এই সমস্যাটা প্রকট। যদিও মার্চেন্টদের পেমেন্ট প্রসেসিং ও সেটেলমেন্টের কিছু বাস্তব খরচ থাকে, তবুও বলা যায়—যদি কেউ এই খরচ বহন করতে না পারেন, তাহলে পস মেশিন ব্যবহার না করার কোন প্রয়োজন নেই। কোন সিস্টেম চালু রেখে, সেই সিস্টেমের অপব্যবহার করার চাইতে সেটি না রাখাই উত্তম। শুধুমাত্র এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভোক্তাকে ঠকানোর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে না। এটি স্পষ্টতই একটি অনৈতিক ব্যবসায়িক মনোভাবের পরিচায়ক।


বাংলাদেশ ব্যাংকের  নির্দেশনা | ইলেকট্রনিক লেনদেনে নির্ধারিত হলো ফি ও এমডিআর হার


২০২১ সালের ১৮ই অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সার্কুলার প্রকাশিত হয়। এ সার্কুলারটি দেশের সকল তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস অপারেটর, পেমেন্ট সার্ভিস ও পেমেন্ট সিস্টেম প্রোভাইডারদের কাছে পাঠানো হয়, যেখানে দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়।


এই সার্কুলারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশ (NPSB) এবং ইন্টারন্যাশনাল পেমেন্ট স্কিম (IPS)-এর আওতায় ইলেকট্রনিক লেনদেনে নির্দিষ্ট পরিমাণ চার্জ বা ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে।


নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে, যদি এক ব্যাংকের গ্রাহক অন্য ব্যাংকের POS (পয়েন্ট অব সেলস) ব্যবহার করে কোনো মার্চেন্ট পেমেন্ট করে, তাহলে সেই লেনদেনে অধিগ্রহণকারী ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান সর্বমোট লেনদেনের ১.৬% এমডিআর (Merchant Discount Rate) হিসেবে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে আদায় করতে পারবে। এর মধ্যে ১.১% বিনিময় ফি (IRF) হিসাবে কার্ড ইস্যুকারী ব্যাংকের জন্য বরাদ্দ থাকবে।


অর্থাৎ, POS লেনদেনে একজন ব্যবসায়ীকে কোনো ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ছাড়াই ১.৬% এমডিআর পরিশোধ করতে হবে, যার বড় একটি অংশ অর্থাৎ ১.১% যাবে কার্ড প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে।


এছাড়া সার্কুলারে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি ইন্টারনেট পেমেন্ট স্কিম (IPS) ব্যবহৃত হয়, তাহলে IRF-এর পাশাপাশি অতিরিক্ত ০.২% চার্জ আরোপ হবে।


ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বাংলা QR কোডের মাধ্যমে কার্ড পেমেন্ট হলে, সেই লেনদেনে মোট ০.৭% এমডিআর ধার্য হবে। যার মধ্যে ০.৪% অংশ যাবে কার্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বিনিময় ফি হিসেবে।


সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—এই সার্কুলারে বাংলাদেশ ব্যাংক স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, এসব ফি কোন অবস্থাতেই গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া যাবে না। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে অধিগ্রহণকারী ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে।


কার্ড পেমেন্টে অতিরিক্ত চার্জ বেআইনি | ব্যাংক কর্মকর্তাদের বক্তব্য


বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে ব্যাংক কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, গ্রাহকদের কার্ড ব্যবহার করতে উৎসাহিত করতে ব্যাংকগুলো সাধারণত ব্যবসায়ীদের কাছে POS (পয়েন্ট অব সেলস) মেশিন সরবরাহ করে থাকে। এসব লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংক ও মার্চেন্টদের মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে—প্রতিটি কার্ড লেনদেনের বিপরীতে নির্ধারিত হারে সার্ভিস চার্জ বা অ্যাকুয়ারিং ফি পরিশোধ করতে হবে মার্চেন্টদের, যা শুধুমাত্র তাদের মুনাফা থেকেই পরিশোধযোগ্য।


এই চার্জ কোনো অবস্থাতেই গ্রাহকের উপর চাপানো যাবে না—এমনটি ব্যাংক চুক্তিতেই উল্লেখ থাকে। অতীতে ব্যাংকগুলো নিজস্ব নীতিমালা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন হারে এই সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করতো, তবে বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী সর্বোচ্চ অ্যাকুয়ারিং ফি ১.৬% নির্ধারণ করা হয়েছে, যা মার্চেন্ট নিজেই বহন করবে।


ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা খোরশেদ আলম এই প্রসঙ্গে বলেন,


"মার্চেন্টদের সাথে আমাদের অ্যাগ্রিমেন্টে পরিষ্কারভাবে লেখা থাকে যে এই চার্জ শুধুমাত্র মার্চেন্টদের কাছ থেকেই নেওয়া হবে, গ্রাহকদের থেকে নয়। তবুও যদি কেউ গ্রাহকের কাছ থেকে চার্জ আদায় করে, সেটি স্পষ্টত বেআইনি।"


বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলামও এই বক্তব্যের সাথে একমত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন,


“কার্ডে পেমেন্ট করলেই গ্রাহককে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হবে, কিন্তু ক্যাশে কিনলে তা দিতে হবে না—এমন কোনো নীতি নেই। ভ্যাট বা কার্ডের বার্ষিক চার্জ আলাদা বিষয়, তবে মার্চেন্টের সার্ভিস চার্জ কোনোভাবেই গ্রাহকের ওপর চাপানো যাবে না। কার্ড বা ক্যাশে পেমেন্ট—এটা সম্পূর্ণ গ্রাহকের পছন্দের বিষয়।”


যদি কেউ অতিরিক্ত চার্জ নেয় তাহলে কী করবেন?


যদি কোনো মার্চেন্ট কার্ড বা ডিজিটাল পেমেন্টে অতিরিক্ত চার্জ দাবি করে, তাহলে প্রথমে প্রমাণ সংগ্রহ করুন—যেমন: রিসিট, পেমেন্টের স্ক্রিনশট ইত্যাদি। এরপর আপনার কার্ড ইস্যুকারী ব্যাংকে অভিযোগ জানান। এছাড়াও Visa, Mastercard বা AMEX-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে গিয়ে সরাসরি অভিযোগ দাখিল করতে পারেন।


বাংলাদেশে আপনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট বিভাগ এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর-এও লিখিত বা অনলাইন অভিযোগ করতে পারেন। এই সংস্থাগুলি প্রয়োজনীয় তদন্ত ও ব্যবস্থা নিতে পারে। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আপনার অভিজ্ঞতা প্রমাণসহ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করাও একটি কার্যকরী উপায় হতে পারে, যাতে অন্য গ্রাহকরা সতর্ক থাকতে পারেন।


আপনি চাইলে নীরব কিন্তু কার্যকর প্রতিবাদ করতে পারেন। যদি কোনো দোকানদার অতিরিক্ত চার্জ দাবি করে, তাহলে আপনি সেখান থেকে না কিনে বিকল্প কোনো সৎ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পণ্য কিনে নিতে পারেন। যিনি অতিরিক্ত চার্জ দাবি করছেন, তাকে বর্জন করুন। এই ধরনের গ্রাহক হারানো তাকে শেখাবে যে অনৈতিক পেমেন্ট প্র্যাকটিস ব্যবসার ক্ষতি ডেকে আনে। সচেতন গ্রাহক হিসেবে এই নীরব প্রতিবাদ ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ ও গ্রাহকবান্ধব করে তুলবে।


তবে কিছু ক্ষেত্রে এমডিআর চার্জ গ্রহণ ন্যায্য হতে পারে—যেমন: সরকারি ফি কালেকশন, কিস্তি পরিশোধ অথবা অনুদান সংগ্রহের মতো ট্রান্সাকশনগুলো।


আমাদের আলোচনার মাধ্যমে এখন আমরা জানতে পারলাম এমডিআর ও পস ফি কী এবং তা কাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমরা সচেতন থাকব এবং অন্যদের সচেতন করতেও ভূমিকা রাখব।


এস এম শামীম হাসান 
ব্র্যান্ড কনটেন্ট ম্যানেজার
ব্যাংকিং আই কিউ


তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা 


নবীনতর পূর্বতন