প্রাইভেট ব্যাংক। খুবই স্বনামধন্য। ব্যাংকের ভিতরেও পরিবেশটা সচেষ্টা চাকচিক্য। প্রত্যেক অফিসার ডেক্সটপ নিয়ে যার যার দেখতে বসে কাজ করছেন। এজন্য কর্মব্যস্তময় পরিবেশ। এরপরেও ব্যাংকে সার্ভিস পেতে গেলে গেলেই তুলনামূলক দীর্ঘ সময় লাগে। এটি আমাদের অনেকের সাধারণ অভিজ্ঞতা। অ্যাকাউন্ট খোলা, টাকা তোলা, চেক ক্লিয়ারেন্স, কিংবা ক্রেডিট কার্ড প্রসেসিং—সব কিছুতেই সময় লেগে যায়। প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেন ব্যাংকের কাজ এত ধীরগতির?
ব্যাংকে গ্রাহকদের ধীর গতির সেবা দেওয়ার মূল কারণগুলো কী?
বুরোক্রেটিক প্রসেস এবং ম্যানুয়াল কার্যক্রম
অনেক ব্যাংকে এখনো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোতে ম্যানুয়াল প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করতে হয়। যদিও বাইরে থেকে ব্যাংকিং সিস্টেমকে সম্পূর্ণ অটোমেটেড মনে হতে পারে, বাস্তবে অনেক ধাপে এখনও কাগজপত্রে অনুমোদন, অফিস থেকে অফিসে ফাইল ঘোরা, এবং একাধিক কর্তৃপক্ষের সিগনেচার প্রয়োজন হয়। এই ধীরগতির বুরোক্রেটিক পদ্ধতি গ্রাহকের জন্য সময়সাপেক্ষ এবং ঝামেলাপূর্ণ হয়ে ওঠে।
উদাহরণস্বরূপ, অনেক গ্রাহক অভিযোগ করেন যে একটি সাধারণ সেভিংস অ্যাকাউন্ট খোলার সময়েও জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই, ঠিকানা ভেরিফিকেশন, এবং ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের চূড়ান্ত অনুমোদনের মতো ধাপ পেরোতে হয়, যা অনলাইনে ফর্ম পূরণের পরও কয়েক দিন সময় নিয়ে ফেলে। অথচ এসব প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় হলে একদিনেই সম্পন্ন হতে পারত।
পর্যাপ্ত এবং দক্ষ জনবলের অভাব
বিশেষ করে সরকারি বা বড় ব্যাংকগুলোতে একেক জন কর্মকর্তা অনেকগুলো কাজ সামলান। এতে কাজের গতি স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। এখানে ভোগান্তি শেষ পর্যন্ত গ্রাহকেরই। একটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকিং সেক্টরে অনেক অদক্ষ লোক দিয়ে একটি জেলা পর্যায়ে ব্রাঞ্চ গুলোতে সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার নিজ জেলা মানিকগঞ্জের একটি বেসরকারি ব্যাংকের জেলা শহরের ব্রাঞ্চ থেকে একজন স্টাফকে বোঝাতে হয়েছিল কোনটা ডেবিট কার্ড এবং কোনটা ক্রেডিট কার্ড। আমি উক্ত ব্যাংকের ভিসা প্লাটিনাম ডেবিট কার্ড ব্যবহার করতাম। অথচ তিনি আমাকে বারবার ফোনে বলছেন এটি ডেবিট কার্ড নয় ক্রেডিট কার্ড, তার বক্তব্য মতে প্লাটিনাম আবার ডেবিট কার্ড হয় কি করে? অর্থাৎ এখান থেকে পরিষ্কার, তার ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড সম্পর্কে ব্যাংক থেকে যথাযথ কোন ট্রেনিং দেওয়া হয়নি।
প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশের অনেক ব্যাংকে এখনো আধুনিক সফটওয়্যার ও অটোমেশন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। যদিও অনেকে অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল অ্যাপ, এবং অন্যান্য ডিজিটাল সেবা চালু করেছে, কিন্তু তাদের ব্যাকএন্ড সিস্টেম এখনো পুরনো ও সীমিত ক্ষমতার। ফলে, নতুন নতুন ডিজিটাল সেবা চালু করার পরেও গ্রাহকের অভিজ্ঞতা অনেক সময় হতাশাজনক হয়ে দাঁড়ায়।
উদাহরণস্বরূপ, অনেক ব্যাংকের মোবাইল অ্যাপ হঠাৎ নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া, রিয়েল-টাইম তথ্য আপডেট হয় না, কিংবা সার্ভার সমস্যার কারণে লেনদেন ব্যাহত হয়। এমনকি কিছু আধুনিক ব্যাংকও পুরনো কোর ব্যাংকিং সিস্টেমের (CBS) উপর নির্ভর করায় ডিজিটাল পরিষেবা সীমিত হয়, এবং নিরাপত্তা ঝুঁকিও থেকে যায়।
প্রতিষ্ঠানের মনোভাব ও সেবার মান:
যেসব প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকসেবাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না, সেখানে সার্ভিস ডেলিভারিতে ধীরগতি একটি স্থায়ী চিত্র হয়ে ওঠে। অনেক ব্যাংক অবকাঠামোগত বা প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বিনিয়োগ করলেও গ্রাহকসেবা বিভাগে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, মনোযোগ বা উদ্ভাবনীতা দেখা যায় না। ফলে ফ্রন্টলাইন কর্মীরা অনেক সময় উদাসীনতা বা ধীরগতির সাথে সেবা প্রদান করেন, যা গ্রাহকের ভোগান্তির মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
উদাহরণস্বরূপ, কোনো একটি শাখায় অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য গ্রাহক সব কাগজপত্র ঠিকভাবে জমা দেওয়ার পরেও দিনের পর দিন কোনো আপডেট পান না। অনুসন্ধান করতে গেলে কর্মকর্তারা কখনো বলেন "ম্যানেজার ব্যস্ত," আবার কখনো "আবার আসেন কালকে।" অথচ একই কাজ অন্য কোনো সেবাপ্রধান প্রতিষ্ঠানে দ্রুত সম্পন্ন হয়ে যায়।
ব্যাংকগুলোর ধীর গতির সার্ভিস এর প্রভাব কী হয়?
ধীরগতির প্রসেস, অতিরিক্ত প্রশ্ন ও অপ্রাসঙ্গিক জটিলতার কারণে গ্রাহকদের মধ্যে বিরক্তি ও হতাশা তৈরি হয়, যার ফলে তারা মূল্যবান সময়ের অপচয়ের শিকার হন। বিশেষ করে প্রযুক্তিনির্ভর নতুন প্রজন্ম, যারা স্বচ্ছ, দ্রুত এবং স্বয়ংক্রিয় সেবা প্রত্যাশা করে, তারা ধীরে ধীরে ঐতিহ্যবাহী ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন। এর পরিবর্তে তারা মোবাইল ফিন্যান্সিং, ডিজিটাল ওয়ালেট, নিও-ব্যাংক এবং অন্যান্য উদ্ভাবনী আর্থিক সেবার প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন, যেখানে কম সময় ও কম জটিলতায় প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়া যায়।
সমাধান কী হতে পারে?
ব্যাংকিং সেবার ধীরগতি ও জটিলতা দূর করতে অটোমেশন ও ডিজিটালাইজেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যেসব কাজ সফটওয়্যারের মাধ্যমে সহজে সম্পন্ন করা সম্ভব, সেগুলো অটোমেটেড করলে সময় ও শ্রম—দুটোই সাশ্রয় হয়। পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা এবং টিমওয়ার্কের মাধ্যমে একাধিক সার্ভিস কাউন্টার সক্রিয় রাখা সেবার মান ও গতি উভয়ই বাড়াতে সহায়ক। গ্রাহকদের সময়ের মূল্য বিবেচনায় ডিজিটাল টোকেন সিস্টেম ও অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট সুবিধা চালু করলে শাখায় অপেক্ষার ভোগান্তি কমবে। একইসাথে অনলাইন ব্যাংকিং সেবার পরিসর বাড়িয়ে এমনভাবে ডিজাইন করতে হবে, যাতে ব্যালেন্স চেক, লেনদেন, চেকবই আবেদন কিংবা সাধারণ তথ্য হালনাগাদসহ ছোট ছোট কাজের জন্য গ্রাহকদের আর শাখায় আসতে না হয়।
সুতরাং, ব্যাংকিং খাতের ধীরগতি শুধুমাত্র গ্রাহকের অসন্তোষই নয়, পুরো আর্থিক ব্যবস্থার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। আধুনিক প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, ও মনোভাবের পরিবর্তনের মাধ্যমেই এই সমস্যা সমাধান সম্ভব।