বাংলাদেশে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। তবে আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের ক্রেডিট কার্ডগুলোর চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে আমেরিকান এক্সপ্রেস (American Express) বা সংক্ষেপে অ্যামেক্স ব্র্যান্ডটি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করেছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে আমেরিকান এক্সপ্রেস বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করলো এবং কীভাবে তারা গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করলো।
বাংলাদেশে আমেরিকান এক্সপ্রেস কার্ডের যাত্রা খুব বেশি দিনের নয়। ২০০৮ সালে, আমেরিকান এক্সপ্রেস-এর একটি টিম বাংলাদেশে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে বাজার জরিপ পরিচালনা করে ব্যবসার সম্ভাবনা অনুসন্ধান করে। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানীয় ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমেক্স কার্ড পরিষেবা চালু করার প্রস্তাব দেয়। তবে তুলনামূলক বেশি প্রসেসিং ফি থাকার কারণে তখন কোনো ব্যাংকই প্রস্তাবটি গ্রহণ করেনি। তবে প্রস্তাবনা না পেলেও , যোগাযোগ করে আমেরিকান এক্সপ্রেস কার্ডের বাংলাদেশ একমাত্র ইস্যুকারী ব্যাংক হিসেবে পার্টনারশিপ হয় আর দেশের বেসরকারি ক্ষেত্রে ব্যাংকের।
এই সময়ে, সিটি ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান মি. আজিজ আল কায়সার প্রস্তাবনা না পেলেও তিনি এখানে একটি সম্ভাবনা দেখতে পান। অন্যান্য ব্যাংকের মতো অপেক্ষা না করে, সিটি ব্যাংক সক্রিয়ভাবে আমেরিকান এক্সপ্রেস-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং সফলভাবে একটি পার্টনারশিপ চুক্তি করে। এর ফলস্বরূপ, ২০০৯ সালের ৯ই নভেম্বর, সিটি ব্যাংক পিএলসি বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকান এক্সপ্রেস ক্রেডিট কার্ড পরিষেবা চালু করে। তখন ব্যাংকটির নাম ছিল দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড।
বাংলাদেশে আমেরিকান এক্সপ্রেস: একটি গেম চেঞ্জার কেন?
বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই আমেরিকান এক্সপ্রেস (অ্যামেক্স) ক্রেডিট কার্ড ক্রমেই অন্যতম জনপ্রিয় ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। সিটি ব্যাংকের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্বের মাধ্যমে আমেক্স দেশের ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেমে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।
প্রাথমিকভাবে সিটি ব্যাংক তিনটি আমেক্স ক্রেডিট কার্ড চালু করে: গ্রিন, ব্লু এবং গোল্ড। পরে তারা প্লাটিনাম কার্ড সংযোজন করে। বর্তমানে সিটি ব্যাংক আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্র্যান্ডেড ডেবিট কার্ড সিটিম্যাক্স সহ প্রিপেইড কার্ড, এবং ভার্চুয়াল ডেবিট ও প্রিপেইড কার্ড ইস্যু করছে।
সিটি ব্যাংক দেশের প্রথম এবং সর্বাধিক জনপ্রিয় রিটেইল চেইন আগোরা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এর সঙ্গে যৌথভাবে কো-ব্র্যান্ডেড ক্রেডিট কার্ড চালু করেছে, যা গ্রাহকদের জন্য বিশেষ সুবিধা নিয়ে এসেছে।
নারীদের জন্য সিটি ব্যাংক সিটি আলো আমেরিকান এক্সপ্রেস কার্ড (City Alo American Express Card) নামে একটি বিশেষ আমেরিকান এক্সপ্রেস কার্ড চালু করেছে, যেখানে রয়েছে একচেটিয়া সুবিধা ও নারী গ্রাহককেন্দ্রিক অফার।
এছাড়াও দেশে প্রথমবারের মতো আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্র্যান্ডের মেটাল ক্রেডিট কার্ড চালু করেছে সিটি ব্যাংক। যা চলতি বছরেই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ধর্মীয়ভাবে অধিকাংশ মানুষ মুসলমান এবং ইসলামিক শিক্ষায় ইন্টারেস্টভিত্তিক লেনদেন নিষিদ্ধ। এই দিকটি বিবেচনায় রেখে, সিটি ব্যাংক তার ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডো “সিটি ইসলামিক”-এর অধীনে ব্লু এবং গোল্ড আমেরিকান এক্সপ্রেস ক্রেডিট কার্ড চালু করেছে। এছাড়াও ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের জন্য বিশেষ আমেরিকান এক্সপ্রেস ডেবিট কার্ড ইস্যু করা হচ্ছে।
এই বিস্তৃত উদ্যোগের মাধ্যমে সিটি ব্যাংক বর্তমানে বাংলাদেশের ৩৫% ক্রেডিট কার্ড মার্কেট দখল করে রেখেছে।
ক্রেডিট কার্ড ইন্ডাস্ট্রিতে সিটি ব্যাংক ও আমেক্স-এর যুগান্তকারী উদ্যোগসমূহ:
দেশের প্রথম আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে, এয়ারপোর্টে আমেরিকান এক্সপ্রেস লাউঞ্জ চালু করেছে, যা কার্ডহোল্ডারদের জন্য এক্সক্লুসিভ প্রিভিলেজ নিশ্চিত করে।
ক্রেডিট লিমিটের বিপরীতে কার্ড চেক ইস্যু করার সুবিধা চালু করেছে, যা অর্থনৈতিক নমনীয়তা বৃদ্ধি করে।
EMI (ইকুয়েটেড মান্থলি ইনস্টলমেন্ট) সুবিধার দ্রুত সম্প্রসারণ, যেখানে ৩ থেকে ৩৬ মাস পর্যন্ত ০% ইন্টারেস্ট-এ পেমেন্ট অপশন চালু করেছে।
ফ্লেক্সিলোন সুবিধার মাধ্যমে ক্রেডিট লিমিটের বিপরীতে সহজে লোন নেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে—যেখানে কাস্টমার কেয়ার-এ কল করেই যোগ্যতা যাচাই করে টাকা গ্রহণ করা যায়।
প্রায়োরিটি পাস, ইন্টারন্যাশনাল রোমিং সাবস্ক্রিপশন সহ আরও অনেক এক্সক্লুসিভ সেবা চালু করে, সিটি ব্যাংক আমেরিকান এক্সপ্রেস ক্রমাগত বাজার নেতৃত্ব ধরে রেখেছে।
সিটি ব্যাংকের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক এবং অবকাঠামো
১৩৪টি শাখা, ৫২টি উপশাখা, ৪৮৫টি এজেন্ট ব্যাংকিং পয়েন্ট, ৪৫৮টি এটিএম, ৭টি প্রায়োরিটি সেন্টার, ৭টি আমেরিকান এক্সপ্রেস সার্ভিস সেন্টার, এবং ৩টি এয়ারপোর্ট লাউঞ্জ ৩৪,০০০+ POS মেশিন এবং ২০,১১৭টি মার্চেন্ট পার্টনার সারাদেশে আমেরিকান এক্সপ্রেস এর সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের মার্কেটে আমেরিকান এক্সপ্রেস এর নিম্নবর্ণিত কার্ডগুলো পাওয়া যাচ্ছে:
- City Bank American Express Gold Card
- City Bank American Express Platinum Card
- City Bank American Express Blue Card
- City Bank American Express Corporate Card
- City Bank American Express Prepaid Card
- Citymax American Express Debt Card
- City Bank American Express Co-branded Cards (e.g., DU/Agora)
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশে অ্যামেক্স-এর এক্সেপটেন্স নেটওয়ার্ক এখনও ভিসা বা মাস্টার কার্ড এর তুলনায় সীমিত। অনেক পজ বা অনলাইন মার্চেন্ট এখনো অ্যামেক্স গ্রহণ করে না। এছাড়া কিছু কার্ডের জন্য বার্ষিক ফি তুলনামূলকভাবে বেশি, যা অনেক গ্রাহকের কাছে বাধা হিসেবে দেখা দেয়।
সম্ভাবনার দিক বলতে গেলে, অ্যামেক্স বিশ্বব্যাপী একটি প্রিমিয়াম ও এক্সক্লুসিভ ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশেও তারা এই ইমেজ বজায় রাখতে চেয়েছে। অ্যামেক্স কার্ডধারীরা সাধারণত উচ্চ আয়ের গ্রাহকগোষ্ঠী – যেমন কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ, প্রবাসী, ভ্রমণকারী এবং উচ্চ ব্যয়ের গ্রাহকদের লক্ষ্য করে। বর্তমানে গ্লোবাল ট্রাভেল, অনলাইন সাবস্ক্রিপশন ও আন্তর্জাতিক কেনাকাটায় অ্যামেক্স এর চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে মাল্টি-কারেন্সি কার্ড ও কাস্টমাইজড রিওয়ার্ড প্রোগ্রামের মাধ্যমে অ্যামেক্স বাংলাদেশি বাজারে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে পারে। আন্তর্জাতিক মানের গ্রাহকসেবা সরবরাহে সক্ষমতা, উন্নত প্রযুক্তি অবকাঠামো এবং ক্রেডিট কার্ড ব্যবস্থাপনায় সিটি ব্যাংকের অভিজ্ঞতা ক্রমশেই ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে।
সুতরাং, বাংলাদেশে ক্রেডিট কার্ড এবং ডিজিটাল ফিন্যান্স সেক্টরে আমেরিকান এক্সপ্রেস একটি গেম চেঞ্জার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যার পেছনে রয়েছে সিটি ব্যাংকের দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং গ্রাহককেন্দ্রিক উদ্ভাবন। একে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশে আমেরিকান এক্সপ্রেসএর যাত্রা একটি সফল ও ভবিষ্যত-সম্ভাবনাময় উদাহরণ। সিটি ব্যাংক এর একচেটিয়া অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এই আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডটি একটি নির্ভরযোগ্য ও প্রিমিয়াম সেবা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। যদি গ্রাহক এক্সেপটেন্স নেটওয়ার্ক, ফি কাঠামো এবং ডিজিটাল সাপোর্টে আরও উন্নয়ন আনা যায়, তবে ভবিষ্যতে অ্যামেক্স বাংলাদেশের ক্রেডিট কার্ড মার্কেটে আরও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারবে।
আমেরিকান এক্সপ্রেস ক্রেডিট কার্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে কল করুন সিটি ব্যাংক কল সেন্টারে। সিটি ব্যাংক কল সেন্টারের তথ্য পেতে এখানে ক্লিক করুন....