ইসলামিক ব্যাংকিং এক ধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থা যা সুদ, জুয়া, মদ, এবং অন্য কোনো শরীয়াহ বিরোধী কার্যক্রম থেকে মুক্ত থাকে। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মূল ভিত্তি হলো শরীয়াহ আইন অনুসরণ করা। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শারিয়া কমপ্লায়েন্স, যা ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রমকে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী পরিচালিত করতে সহায়তা করে। শরীয়াহ কমপ্লায়েন্স ব্যাংকের প্রতিটি লেনদেন এবং আর্থিক কার্যক্রমে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা মেনে চলার নিশ্চয়তা দেয়।
আমাদের বাংলাদেশ ইসলামিক ব্যাংকিং এর প্রতি মানুষের আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে এদেশের মানুষ অধিকাংশ মুসলমান। আমরা এ পর্যায়ে সকলের জ্ঞাতার্থে ইসলামিক ব্যাংকিং এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি টার্ম শারিয়া কমপ্লায়েন্স নিয়ে ছোট্ট পরিসরে একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব ইনশাল্লাহ।
শারিয়া কমপ্লায়েন্স কী?
শারিয়া কমপ্লায়েন্স বা শরীয়াহ সম্মতি হলো একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের আর্থিক লেনদেন ও কার্যক্রম ইসলামী শরীয়াহ আইন অনুযায়ী পরিচালনা করা। ইসলামী ব্যাংকিংয়ে সুদ বা "রিবা" এবং অন্যান্য শরীয়াহ বিরোধী কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হয়। ব্যাংকগুলো শরীয়াহ কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে একটি শারিয়া কমপ্লায়েন্স অফিস বা বোর্ড গঠন করে, যারা নিশ্চিত করে যে সকল ব্যাংকিং সেবা ও লেনদেন শরীয়াহ আইন অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিটি ইসলামিক ব্যাংক, প্রচলিত ব্যাংক যাদের ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডো রয়েছে, এমনকি ইসলামিক ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলো তাদেরও স্বতন্ত্র শারিয়াহ সুপারভাইজারি কমিটি রয়েছে। যেখানে একজন এই কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সাথে আরো বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য ইসলামিক স্কলার এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়ে।
শারিয়া কমপ্লায়েন্সের গুরুত্ব:
ধর্মীয় মৌলিকত্ব: ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে শরীয়াহ আইন অনুসারে লেনদেন করা। মুসলিম সমাজের জন্য এই কমপ্লায়েন্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যদি ব্যাংক শরীয়াহ সম্মত না হয়, তবে তা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য হবে না।
বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রাহক আস্থা: শরীয়াহ কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করলে ইসলামী ব্যাংকিং গ্রাহকদের কাছে আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। গ্রাহকরা তাদের অর্থ ইসলামী নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যাংকিং সিস্টেমে রাখতে পছন্দ করেন, যা তাদের ধর্মীয় আস্থা ও বিশ্বাসকে মদত দেয়।
আইনি সুরক্ষা: শরীয়াহ কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা ইসলামী ব্যাংকিংয়ের আইনি সুরক্ষা বাড়ায়। যদি কোনো লেনদেন বা কার্যক্রম শরীয়াহ বিরোধী হয়, তবে তা আদালতের কাছে চ্যালেঞ্জ হতে পারে। শারিয়া কমপ্লায়েন্স তা প্রতিরোধ করে, কারণ এটি নিশ্চিত করে যে ব্যাংকগুলোর সকল কার্যক্রম শরীয়াহ আইন মেনে চলছে।
আর্থিক ন্যায়বিচার: ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মূল উদ্দেশ্য হলো আর্থিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। শারিয়া কমপ্লায়েন্স অনুসরণ করলে ব্যাংক গ্রাহকদের সঙ্গে ন্যায্য লেনদেন করবে এবং কোনো ধরনের প্রকারভেদ বা অপ্রত্যাশিত আর্থিক দোষ থেকে বিরত থাকবে। এতে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ন্যায্য, সৎ এবং সমতাবাদী হয়।
বৈশ্বিক সঙ্গতি: ইসলামী ব্যাংকিং বর্তমানে বৈশ্বিকভাবে দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে, এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। শরীয়াহ কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা ব্যাংকগুলোর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বজায় রাখতে সহায়তা করে। এটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বাজারে ইসলামী ব্যাংকগুলোর সঙ্গতি এবং অংশগ্রহণকে শক্তিশালী করে।
আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক: অনেক আন্তর্জাতিক ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের শারিয়া কমপ্লায়েন্সের ভিত্তিতে আর্থিক সেবা প্রদান করে। শরীয়াহ সম্মত কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো বৈশ্বিক আর্থিক বাজারে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয়।
ব্যাংকিং সিস্টেমের উন্নয়ন: শারিয়া কমপ্লায়েন্স ব্যাংকিং সিস্টেমের স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ব্যাংকের কর্মপদ্ধতি এবং আর্থিক পণ্যের ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখতে সহায়তা করে, যা ব্যাংকিং খাতে একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করে।
শারিয়া কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলো কীভাবে কাজ করে?
শারিয়া বোর্ড প্রতিষ্ঠা: উপরে দুটি বর্ণনা করেছিলাম, ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের কার্যক্রমের শরীয়াহ সম্মতি নিশ্চিত করতে একটি শারিয়া বোর্ড গঠন করে। এই বোর্ড শরীয়াহ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত এবং তারা ব্যাংকিং কার্যক্রমের প্রতি সময়মত পর্যালোচনা ও পরামর্শ প্রদান করে।
প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ: ইসলামী ব্যাংকিংয়ের শারিয়া কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। পাশাপাশি, ব্যাংকের কর্মীদের শরীয়াহ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়, যাতে তারা শরীয়াহ আইন অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হন।
নিরবচ্ছিন্ন অডিট: ব্যাংকগুলো নিয়মিত শরীয়াহ অডিট সম্পাদন করে, যা তাদের কার্যক্রমের শারিয়া সম্মতি যাচাই করে। এই অডিটের মাধ্যমে যেকোনো ধরনের ভুল বা শরীয়াহ বিরোধী কার্যক্রম চিহ্নিত করা হয়।
ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের শারিয়া কমপ্লায়েন্স ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অন্যতম ভিত্তি। এটি ইসলামী ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রমকে শরীয়াহ সম্মত ও নৈতিকভাবে সঠিক রাখে, এবং গ্রাহকদের কাছে এক সততা ও আস্থা অর্জন করে। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং সিস্টেমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয় এবং সঠিক আর্থিক লেনদেন পরিচালিত হয়, যা মুসলিম সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।