বর্তমান স্মার্ট যুগে যখন সবকিছুই ছোঁয়ার আগেই ঘটে যাচ্ছে, তখন ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতও পিছিয়ে নেই। আধুনিক ফিনটেক লেনদেনের যুগান্তকারী এবং অন্যতম সলিউশন হল NFC (Near Field Communication) বা NFC প্রযুক্তি। খুব ছোট দূরত্বে (সাধারণত ৪ সেন্টিমিটারের মধ্যে) দুইটি ডিভাইসের মধ্যে দ্রুত ও নিরাপদ তথ্য আদান-প্রদানের জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়।
এনএফসি প্রযুক্তির মাধ্যমে টাচলেস পেমেন্ট এবং ডিজিটাল ব্যাংকিং আরও সহজ ও নিরাপদ হয়ে উঠেছে। নিচে আলোচনা করা হলো ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে NFC প্রযুক্তির ব্যবহার এবং এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে।
টাচলেস বা কনট্যাক্টলেস পেমেন্ট সিস্টেম
NFC প্রযুক্তির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যবহার হলো কনট্যাক্টলেস পেমেন্ট। বর্তমানে বাংলাদেশে কিছু ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক কার্ড নেটওয়ার্ক (যেমন: Visa , Mastercard , American Express etc) এই সুবিধা দিচ্ছে। গ্রাহক শুধু তার কার্ড বা স্মার্টফোন POS মেশিনের কাছে ধরলেই পেমেন্ট সম্পন্ন হয়—পিন বা সিগনেচারের দরকার হয় না (নির্ধারিত লিমিট পর্যন্ত)।
মোবাইল ওয়ালেট ও স্মার্টফোন পেমেন্ট
Google Pay অনুরূপ Apple Pay, Samsung Pay এর মত NFC-ভিত্তিক পেমেন্ট প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা তাদের ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড সংযুক্ত করে স্মার্টফোন দিয়েই পেমেন্ট করতে পারেন।
ব্যাংকিং বুথ ও এটিএমে টোকেনবিহীন লেনদেন
অনেক আধুনিক এটিএমে এখন কার্ড ছাড়াও NFC ফোনের মাধ্যমে লেনদেন করা যাচ্ছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোও এই ধরনের "Tap & Withdraw" সুবিধা চালু করতে পারে, যা গ্রাহক সুরক্ষার ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব। যেমন সম্প্রতি সিটি ব্যাংক পিএলসি তাদের এটিএম বুথ গুলোতে এনএফসি রিডার সংযোজন এবং সক্রিয় করেছে যার ফলে গ্রাহকগণ কার্ড সরাসরি এটিএম মেশিনে প্রবেশ না করিয়ে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাস্ট ট্যাপ করে তার প্রয়োজনীয় সেবা গ্রহণ করতে পারছেন। হয়তো ধাপে ধাপে অন্যান্য ব্যাংক এই সুবিধা গুলো সংযোজন করবে বা করছে।
ফিজিক্যাল কার্ডের বিকল্প: ভার্চুয়াল এনএফসি কার্ড
অনেক ব্যাংক এখন ভার্চুয়াল কার্ড ইস্যু করছে যা মোবাইল ওয়ালেটে সেভ থাকে এবং NFC দিয়ে ব্যবহারযোগ্য। এতে গ্রাহকদের আর ফিজিক্যাল কার্ড বহন করতে হয় না, এবং এর ফলে গ্রাহকের কার্ডের নিরাপত্তাও বাড়ে। সিটি ব্যাংক, ব্রাক ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ইত্যাদি এখন ভার্চুয়াল কার্ড ইস্যু করছে। অপরদিকে খরচ বিবেচনায় ফিজিক্যাল প্লাস্টিক বা মেটাল কার্ডের তুলনায় ভার্চুয়াল কার্ডের খরচ অত্যন্ত কম।
লেনদেনের নিরাপত্তা ও এনক্রিপশন
NFC প্রযুক্তি ডেটা এনক্রিপশন ও টোকেনাইজেশন ব্যবহার করে, যার ফলে হ্যাকিং বা ডেটা ক্লোনিংয়ের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। পেমেন্ট কার্ডের প্রকৃত তথ্য কখনোই POS মেশিনে সরাসরি পাঠানো হয় না—বরং একটি টেম্পোরারি এনক্রিপটেড টোকেন পাঠানো হয়। যা নিরাপদ একটি পেমেন্ট পদ্ধতি নিঃসন্দেহে।
ব্যবসায়ী ও গ্রাহকের জন্য দ্রুত পরিষেবা
POS মেশিনে NFC সুবিধা থাকলে গ্রাহকের লেনদেন সম্পন্ন করতে সময় লাগে মাত্র ১-২ সেকেন্ড। এতে ব্যবসায়ীদের সার্ভিস টাইম কমে, কাস্টমার স্যাটিসফ্যাকশন বাড়ে, এবং ট্রানজেকশন সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আরেকটু বড় সুবিধা হচ্ছে, ছোট ছোট এমাউন্ট লেনদেনের ক্ষেত্রে কোন পিন নাম্বারে প্রয়োজন হয় না, তাই সময় অনেক কম নষ্ট হয়, এবং অল্প সময়ে অধিক কাস্টমারদের সেবা প্রদান করা যায়।
ব্যাংক ও ফিনটেক সল্যুশনে NFC ইন্টিগ্রেশন
দেশীয় ফিনটেক প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন: Pathao Pay, ipay, ST Pay, Pocket Wallet ইত্যাদি) যদি NFC ভিত্তিক পেমেন্ট ইন্টিগ্রেশন চালু করে, তবে ডিজিটাল অর্থনীতি ও স্মার্ট ব্যাংকিং-এর প্রসার আরও ত্বরান্বিত হবে।
সুতরাং, NFC প্রযুক্তি কেবলমাত্র একটি বিল পরিশোধের মাধ্যম নয়—এটি নিরাপত্তা, গতি ও গ্রাহক সুবিধার এক অনন্য সংমিশ্রণ। বাংলাদেশে ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের যে উত্থান ঘটছে, NFC তার অন্যতম চালক শক্তি হতে পারে।