বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় সব ব্যাংকই আমানতের (ডিপোজিট) বিপরীতে গ্রাহকদের ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করে থাকে। একে বলা হয় সিকিউরড ক্রেডিট কার্ড। এখানে গ্রাহক তার এফডিআর (Fixed Deposit), ডিপিএস, চলতি বা সেভিংস অ্যাকাউন্টের নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যালেন্স বা অন্য কোনো সেভিংস স্কিমের বিপরীতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে ব্লক বা লিয়েন করে রেখে ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ করেন।
সাধারণত ব্যাংকগুলো গ্রাহকের গচ্ছিত টাকার ৮০% থেকে ৯০% পর্যন্ত সীমা (লিমিট) নির্ধারণ করে কার্ড ইস্যু করে। কিন্তু এই সুবিধাটি অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়—অনেকে একে প্রিপেইড ইএমআই কার্ড, এমনকি ডেবিট কার্ডের নতুন সংস্করণ বলেও ট্রল করে থাকেন।
তাহলে প্রশ্ন আসে, এই সমালোচনা কতটা যৌক্তিক?
মূলত ক্রেডিট কার্ড একটি আনসিকিউরড প্রোডাক্ট, যা একজন গ্রাহকের অর্থনৈতিক যোগ্যতা, চাকরি, আয়, CIB রিপোর্ট, ট্যাক্স রেকর্ডসহ নানা দিক বিশ্লেষণ করে ইস্যু করা হয়। কিন্তু যারা এইসব যোগ্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নন, তারা সিকিউরড কার্ড গ্রহণ করে ক্রেডিট সুবিধা উপভোগ করতে পারেন। এটিকে কখনোই প্রিপেইড বা ডেবিট কার্ডের সঙ্গে তুলনা করা উচিত নয়। কারণ এটি আসলে একটি ক্রেডিট লাইনের বিপরীতে নিরাপত্তা গ্যারান্টি মাত্র।
অপরদিকে, আমাদের অনেকেরই বিভিন্ন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এফডিআর, ডিপিএস বা সেভিংস স্কিমের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ দীর্ঘদিন ধরে জমা থাকে, যেগুলো আমরা অনেক সময় ব্যবহারই করি না। এমন পরিস্থিতিতে যদি আমরা ওই সঞ্চয়ের বিপরীতে একটি সিকিউরড ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ করি এবং তা যথাযথভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে এর প্রকৃত সুবিধাগুলো উপভোগ করি—যেমন ইন্টারেস্ট-ফ্রি পিরিয়ড, ডিসকাউন্ট, ক্যাশব্যাক, বিল পেমেন্ট, ইএমআই সুবিধা—তাহলে তা আমাদের জন্য হতে পারে একটি লাভজনক ও স্মার্ট আর্থিক সিদ্ধান্ত।
সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে আমানতের বিপরীতে কার্ড গ্রহণ করলে এটি শুধুমাত্র একটি খরচ নয়, বরং একটি কার্যকর অর্থ ব্যবস্থাপনার উপায় হয়ে উঠতে পারে।
কেন আপনি সিকিউরড ক্রেডিট কার্ড নেবেন?
ক্রেডিট হিস্ট্রি তৈরি: যারা নতুন বা ছাত্র কিংবা উদ্যোক্তা—তারা এভাবে ধীরে ধীরে একটি ভালো ক্রেডিট প্রোফাইল তৈরি করতে পারেন।
বহু সুবিধা উপভোগ: সিকিউরড হোক বা আনসিকিউরড—দুই ধরনের কার্ডেই আপনি ইএমআই, ক্যাশব্যাক, রিওয়ার্ড পয়েন্ট, আন্তর্জাতিক লেনদেন, প্রায়োরিটি পাস, ইন্টারেস্ট ফ্রি পিরিয়ড ইত্যাদি সব সুবিধা পাবেন।
নগদায়নের স্বাধীনতা: আপনি যখন কার্ড ব্যবহার বন্ধ করবেন বা পূর্ণ বিল পরিশোধ করবেন, তখনই আপনার ব্লক করা আমানত আবার আপনি ফেরত পেয়ে যাবেন।
আমানতের ইন্টারেস্ট: অনেকেই মনে করেন, আমানতের বিপরীতে কার্ড গ্রহণ করলে সেই ডিপোজিটের উপর ইন্টারেস্ট বন্ধ হয়ে যায়—অথচ বাস্তবে আপনি নিয়মিতভাবে সেই ইন্টারেস্ট পেয়ে যাবেন।
তাহলে সমস্যা কোথায়?
অনেকেই শুধুমাত্র একটি ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার উদ্দেশ্যে নিজের প্রয়োজন না বুঝেই ব্যাংকে আমানতের বিপরীতে লিয়েন করে কার্ড গ্রহণ করেন। অথচ কার্ড ব্যবহারে যদি সচেতনতা না থাকে—যেমন সঠিকভাবে লেনদেন না করা, বিল সময়মতো পরিশোধ না করা বা কেবল সীমিত কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে কার্ড নেওয়া—তাহলে তা বছর শেষে অপ্রয়োজনীয় খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে। এতে বাৎসরিক চার্জ, লেট ফি, ইন্টারেস্টসহ একাধিক খরচ যোগ হয়ে আপনাকে আর্থিকভাবে চাপের মুখে ফেলতে পারে।
আপনার ব্যবহারের ধরন যদি এমন হয়, তাহলে শুধু সিকিউরড (অর্থাৎ আমানতের বিপরীতে) কার্ড নয়, আনসিকিউর কার্ডও—যা সাধারণত ব্যাংকের মনোনীত ও প্রোফাইলভিত্তিক গ্রাহকদের দেওয়া হয়—আপনার জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে।
সঠিক পরিকল্পনা ও দায়িত্বশীল ব্যবহারের মাধ্যমেই একটি ক্রেডিট কার্ড হতে পারে আপনার আর্থিক ব্যবস্থাপনার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
সিকিউরড কার্ড কি ব্যর্থতা?
না, এটি মোটেই ব্যর্থতা নয়। বরং এটি একটি স্মার্ট কনজিউমার প্র্যাকটিস। আপনি যদি যোগ্য নাও হন তবুও আপনার প্রয়োজন হলে, নিজের সঞ্চয়কে সুরক্ষিত রেখে ব্যাংক থেকে একটি নির্ভরযোগ্য লোনলাইন নিতে পারবেন। আর এটিই হ’ল সিকিউরড ক্রেডিট কার্ডের মূল উদ্দেশ্য।
সুতরাং, আপনার এফডিআর বা সেভিংস স্কিমের বিপরীতে ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ করাকে ছোট করে দেখা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। এটি এক ধরনের নিরাপদ ও দায়িত্বশীল আর্থিক সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে যখন আপনি নিজে যোগ্য নন বা নতুনভাবে অর্থনৈতিক পরিসরে প্রবেশ করছেন। ব্যালেন্স গচ্ছিত রাখার মাধ্যমে আপনি ব্যাংকের কাছে এক ধরনের গ্যারান্টি দিচ্ছেন, এবং বিনিময়ে পাচ্ছেন পূর্ণাঙ্গ একটি ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা। তাই প্রিপেইড বা ডেবিট কার্ড বলে ট্রল না করে সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করাই হবে একজন স্মার্ট ইউজারের পরিচয়।