সিআইবি ঋণগ্রহীতাদের আচরণ মূল্যায়নের বাংলাদেশ ব্যাংকের ডকুমেন্টেড একটি মানদন্ড। বাংলাদেশের আর্থিক খাতে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ঋণগ্রহীতাদের আচরণ মূল্যায়নের অন্যতম কার্যকর উপাদান হচ্ছে ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (CIB)। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে পরিচালিত একটি বিশেষায়িত বিভাগ, যার প্রধান দায়িত্ব হলো দেশের সকল তফসিলি ব্যাংক এবং ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ, লিজ এবং ক্রেডিট কার্ড-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করা।
বাংলাদেশে অধিকাংশ গ্রাহক প্রথমবার সিআইবি (CIB) সম্পর্কে অবগত হন তখনই, যখন তারা কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রথমবারের মতো ঋণ বা ক্রেডিট কার্ডের জন্য আবেদন করেন। আবার কেউ কেউ প্রথমবার ঋণ বা কার্ডে ডিফল্ট বা খেলাপি হওয়ার পর যখন দ্বিতীয়বার নতুন করে লোন বা কার্ডের জন্য আবেদন করেন এবং আবেদন বাতিল হয়, তখন বিষয়টি জানতে পারেন। পরবর্তীতে তারা বুঝতে পারেন যে, পূর্বের ঋণ বা ক্রেডিট কার্ড সংক্রান্ত আর্থিক আচরণ বা লেনদেন–যেমন সময়মতো বিল পরিশোধ না করা বা কিস্তি বকেয়া রাখা–এসব তথ্য একটি নির্দিষ্ট প্রতিবেদনে সংরক্ষিত রয়েছে। এই প্রতিবেদনটিই হলো CIB রিপোর্ট, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনস্থ ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো দ্বারা প্রস্তুত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।
আজকের এই আলোচনা জানার চেষ্টা করব, সিআইবি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়ার জন্য।
সিআইবি’র প্রতিষ্ঠার পটভূমি
১৯৯২ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়িত ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর রিফর্ম প্রজেক্ট (FSRP)-এর আওতায় CIB প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল—ব্যাংকিং খাতে ঋণের ঝুঁকি হ্রাস, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ এবং ঋণ প্রদানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
সিআইবি রিপোর্ট কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ?
সিআইবি রিপোর্ট হচ্ছে একজন ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক ঋণগ্রহীতার অতীত ও বর্তমান ঋণ সম্পর্কিত একটি সার্বিক প্রতিবেদন। এতে ঋণের পরিমাণ, পরিশোধের নিয়মিততা, পুনঃতফসিল বা অবলোপনের তথ্যসহ গ্রাহকের আর্থিক শৃঙ্খলার একটি পরিষ্কার চিত্র উঠে আসে। এটি যেকোনো নতুন ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে একটি প্রাথমিক ও বাধ্যতামূলক যাচাই উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি কোনো ব্যাংক থেকে ক্রেডিট কার্ডের জন্য আবেদন করেন, তাহলে প্রথমেই সংশ্লিষ্ট ব্যাংক আপনার সিআইবি রিপোর্ট যাচাই করবে। যদি দেখা যায়, আপনার পূর্বের কোনো ঋণের কিস্তি কিংবা ক্রেডিট কার্ড বিল নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ হয়নি, তাহলে সেটি নেগেটিভ এন্ট্রি হিসেবে রিপোর্টে উল্লেখ থাকবে, যা নতুন কার্ড অনুমোদনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কোন কোন তথ্য সিআইবিতে রিপোর্ট করা হয়?
- সব ধরনের ঋণ, লিজ, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি তথ্য প্রতিমাসে সিআইবিতে আপডেট আকারে পাঠাতে হয়।
- পুনঃতফসিলকৃত ঋণ বা অবলোপনকৃত হিসাব হলেও তা রিপোর্টের আওতায় পড়ে।
- ক্রেডিট কার্ড বিল যদি ডিউ ডেটের পরে পরিশোধ করা হয়, তাও সিআইবি রিপোর্টে নেগেটিভ রেকর্ড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
সিআইবি রিপোর্টের প্রভাব
সিআইবি রিপোর্ট শুধুমাত্র নতুন ঋণের ক্ষেত্রে নয়, বরং ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক স্বাস্থ্যের উপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এটি একটি প্রকার আর্থিক সিভি, যার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয় আপনার ঋণ গ্রহণযোগ্যতা।
একজন গ্রাহক যদি কোনো কারণে ঋণ খেলাপিতে পরিণত হন এবং পরে সেই হিসাব অবলোপন করা হয়, তাহলেও তার তথ্য সিআইবিতে থেকে যায় এবং ভবিষ্যতে ঋণ গ্রহণে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
শেয়ারবাজারে CIB রিপোর্টের গুরুত্ব
সিআইবি রিপোর্ট শুধুমাত্র ব্যাংকিং খাতে সীমাবদ্ধ নয়—এর প্রভাব রয়েছে শেয়ারবাজারের প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (IPO) ও রাইট শেয়ার ইস্যু ক্ষেত্রেও। সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী, কোনো কোম্পানির পরিচালকদের মধ্যে কেউ যদি ঋণ খেলাপি হন, তবে সেই কোম্পানির IPO বা রাইট শেয়ারের আবেদন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (BSEC) বাতিল করতে পারে। এজন্য BSEC সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের CIB থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এবং পরিচালকদের ঋণ পরিস্থিতির প্রতিবেদন সংগ্রহ করে।
ব্যক্তিগত সচেতনতা ও সিআইবি
অনেক সময় গ্রাহকরা অজান্তেই সিআইবি রিপোর্টে নেগেটিভ এন্ট্রি তৈরি করেন—যেমন, ক্রেডিট কার্ড বিল কয়েকদিন দেরিতে পরিশোধ, কোনো ঋণের কিস্তি অনিয়মিত হওয়া ইত্যাদি। এ ধরনের আচরণ ভবিষ্যতে নতুন লোন বা কার্ড গ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই সকল ঋণ সম্পর্কিত দায়বদ্ধতা সময়মতো পরিশোধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সুতরাং, সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) হলো বাংলাদেশে আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার একটি অপরিহার্য ও কেন্দ্রীয় যন্ত্র। এটি এমন একটি তথ্যভান্ডার, যেখানে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একটি প্রতিষ্ঠানে খেলাপি হলে সেই তথ্য নেতিবাচক এন্ট্রি হিসেবে সংরক্ষিত হয়। এর ফলে, আপনি যদি একটি ব্যাংকে বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ বা ক্রেডিট কার্ডে খেলাপি হন, তাহলে ভবিষ্যতে অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানে আর্থিক সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে আপনাকে জটিলতায় পড়তে হতে পারে। কারণ, আমরা এতক্ষণে যে বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছি তা হলো—এই রিপোর্টটি সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত হয়। এতে প্রতিফলিত হয় আপনার আর্থিক আচরণ ও দায়িত্বশীলতা। সিআইবি রিপোর্ট একটি ব্যক্তির আর্থিক বিশ্বাসযোগ্যতার পরিচায়ক হিসেবে কাজ করে এবং ভবিষ্যতের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। তাই এটি কোনোভাবেই অবহেলা করার বিষয় নয়। সময়মতো ঋণ বা বিল পরিশোধের মাধ্যমে একটি পরিষ্কার ও ইতিবাচক সিআইবি প্রোফাইল গড়ে তোলা প্রত্যেক গ্রাহকের দায়িত্ব ও প্রয়োজন।