বাংলাদেশে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ইসলাম ধর্মে সুদ (রিবা) নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে অনেকেই সুদমুক্ত অর্থনৈতিক লেনদেনের প্রতি স্বভাবতই আগ্রহী। ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে ইসলামিক ব্যাংকিং প্রথা একটি শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। এ ধারার সেবা ব্যবস্থার মধ্যে অন্যতম একটি পণ্য হচ্ছে ইসলামিক ক্রেডিট কার্ড, যা শরিয়া সম্মত লেনদেনের মাধ্যমে সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডো বা পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক ব্যাংকিং কাঠামোর আওতায় ইসলামিক ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করছে। উদাহরণস্বরূপ, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক তাদের ‘সাদিক’ ইসলামিক উইন্ডোর আওতায় ইসলামিক কার্ড চালু করেছে। সিটি ব্যাংক ‘সিটি ইসলামিক’ উইন্ডোর অধীনে সিটি ইসলামিক ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করছে। মূল ধারার ইসলামিক ব্যাংকিং গুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি ‘খিদমাহ’ নামে এবং আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ‘লা রিবা’ নামে ইসলামিক ক্রেডিট কার্ড বাজারে এনেছে। এছাড়া এক্সিম ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক ও আরও কিছু ব্যাংক ইসলামিক ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করছে।
তবে এই খাতের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো, গ্রাহকের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে একটি বড় ফারাক থেকে যাচ্ছে। অধিকাংশ ধর্মপ্রাণ মুসলমান মনে করেন, ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় খরচের পরিমাণ কম এবং লাভের অংশ বেশি হবে। ইসলামিক ধারার ব্যাংক থেকে তারা একটি নৈতিক, কম খরচের এবং লাভজনক সেবা পাওয়ার আশায় থাকেন। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, এই প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবের পার্থক্য রয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইসলামিক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীরা প্রায়ই বুঝতে পারেন, প্রচলিত ব্যাংকের কার্ডের তুলনায় ইসলামিক কার্ডে খরচ বেশি, সুবিধা কম এবং প্রক্রিয়া জটিল।
প্রচলিত ক্রেডিট কার্ড সাধারণত ইন্টারেস্ট বেইসড সিস্টেমের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। গ্রাহক যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পূর্ণ বিল পরিশোধ করেন, তাহলে তাকে কোনো অতিরিক্ত ইন্টারেস্ট দিতে হয় না। কিন্তু বিলের মিনিমাম অংশ পরিশোধ করলে অবশিষ্ট বকেয়ার ওপর দৈনিক ভিত্তিতে ইন্টারেস্ট চার্জ করা হয়, যা বর্তমান সকল ব্যাংকের ফ্লাট রেট ইন্টারেস্ট অনুযায়ী বার্ষিক গড়ে প্রায় ২০ শতাংশ এবং মাসিক হিসেবে ১.৬৭ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি হাজার টাকায় প্রতিদিন প্রায় ৫৬ পয়সা হারে ইন্টারেস্ট প্রযোজ্য হয়।
অন্যদিকে ইসলামিক ব্যাংকিং ধারায় পরিচালিত ক্রেডিট কার্ডে এ ধরনের সুদের ধারণা একেবারে বাদ দেওয়া হয়েছে। এখানে শরিয়া মডেল অনুসরণ করে মুরাবাহা, ইজারা বা উজর ভিত্তিক চার্জ কাঠামো অনুসরণ করা হয়। কিন্তু এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিলের মিনিমাম অংশ পরিশোধ করলে অবশিষ্ট বকেয়ার ওপর সরাসরি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চার্জ প্রযোজ্য হয় – যেমন ৫০০ টাকা, ১০০০ টাকা বা ২০০০ টাকা, যা গ্রাহকের বকেয়ার পরিমাণ যতই কম হোক না কেন, নির্দিষ্টভাবে কেটে নেওয়া হয়। এতে তুলনামূলকভাবে কম বকেয়ার ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত খরচ গুনতে হয়।
তাছাড়া প্রচলিত ক্রেডিট কার্ডে যে সুবিধাগুলো পাওয়া যায় – যেমন স্বল্প ইন্টারেস্ট রেটে ইএমআই, ক্যাশব্যাক, ডিসকাউন্ট অফার, ফ্লেক্সিলোন, কার্ড চেকের মাধ্যমে নগদ উত্তোলন বা অ্যাড মানির ক্ষেত্রে ৪৫ দিন থেকে ৫০ দিন পর্যন্ত ইন্টারেস্ট ফ্রি পিরিয়ড এবং পরবর্তী সময়ে কার্ড হোল্ডারের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন টার্মে ইনস্টলমেন্টে কনভার্ট করে পেমেন্ট করার সুবিধা– এসব ক্ষেত্রেও ইসলামিক কার্ডগুলো অনেক সময় পিছিয়ে থাকে বা এসব সুবিধা দিতে পারে না। শরিয়া কমপ্লায়েন্স বজায় রাখতে গিয়ে প্রযুক্তিগত ও নীতিগত সীমাবদ্ধতার কারণে এসব ফিচার সহজে অন্তর্ভুক্ত করা যাচ্ছে না।
ইসলামিক ব্যাংকিং প্রোডাক্ট ডিজাইনে ইসলামিক স্কলারদের মতামত:
ইসলামের দৃষ্টিতে সুদ হারাম হওয়ার বিষয়টি সর্বজনবিদিত। তবে শরিয়া সম্মত প্রফিট মডেল অনুসরণ করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যায়। এক্ষেত্রে শরিয়া স্কলারদের মত হচ্ছে – লাভের নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় যদি বাস্তবে রিবার কাছাকাছি চলে যায়, তাহলে সেটিও ইসলামিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
এ বিষয়ে প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলারদের মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের মুফতি তাকি উসমানি, যিনি An Introduction to Islamic Finance গ্রন্থের মাধ্যমে ইসলামিক ফিন্যান্সের মৌলিক কাঠামো ব্যাখ্যা করেছেন, তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে কোনো লেনদেন যদি নামমাত্র শরিয়া সম্মত হয় কিন্তু বাস্তবে রিবার (সুদের) মতো আচরণ করে, তাহলে সেটি শরিয়া পরিপন্থী। বাহরাইনের শাইখ নিজাম ইয়াকুবি, যিনি AAOIFI ও Dow Jones Islamic Index-এর শরিয়া বোর্ডে রয়েছেন, তাঁর মতে ইসলামিক ফিনান্স শুধু চুক্তির নামে পরিবর্তন করলেই চলে না; বরং এর অর্থনৈতিক বাস্তবতাও শরিয়ার মূল চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
মালয়েশিয়ার ড. দাউদ বকর, যিনি Shariah Minds in Islamic Finance বইয়ের লেখক, তিনিও বলেন, ‘গোপন রিবা’ বা অতিরিক্ত অন্যায্য মুনাফা থাকলে সেটিও শরিয়া-পরিপন্থী।
এছাড়া মুফতি ইমরান উসমানি বলেন, শরিয়া কমপ্লায়েন্স কেবল আইনি কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সামাজিক ও নৈতিক মানদণ্ডও বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এসব বিশিষ্ট স্কলারদের অভিমত থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, ইসলামিক ব্যাংকিং প্রোডাক্ট ডিজাইনের ক্ষেত্রে শরিয়া নামধারী ফর্মালিটি নয়, বরং বাস্তবিক ইনটেনশন ও ট্রান্সপারেন্সিই মূল বিবেচ্য হওয়া উচিত।
ফলে ইসলামিক ব্যাংকিং-এর সেবাগুলো শুধু নামমাত্র শরিয়া ভিত্তিক হলেই চলবে না, বরং ব্যবহারকারীর দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি ন্যায়সংগত, স্বচ্ছ এবং গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
ইসলামিক ব্যাংকিং নিয়ে এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় ও কি কি করা যেতে পারে?
এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণের জন্য ইসলামিক ব্যাংকিং খাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, শরিয়া বোর্ড এবং ব্যাংক উভয়কে মিলে গ্রাহকবান্ধব, সহজবোধ্য এবং খরচ সাশ্রয়ী চার্জ কাঠামো তৈরি করতে হবে। ফিনান্সিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে এমন একটি কার্ড মডেল তৈরি করতে হবে যা শরিয়া মেনে চলে, কিন্তু গ্রাহকের জন্য জটিলতা তৈরি করে না। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে – যেমন রিয়েল টাইম ট্রানজেকশন আপডেট, স্পষ্ট চার্জ ব্রেকডাউন, এবং সহজ অ্যাপভিত্তিক কনট্রোল সুবিধা চালু করা। তৃতীয়ত, প্রচলিত ব্যাংকের মতো গ্রাহক আকর্ষণের জন্য ইন্টারেস্টবিহীন ডিসকাউন্ট, পয়েন্ট, কুপন বা অফার যুক্ত করা যেতে পারে।
সবশেষে, ব্যাংকগুলোর উচিত গ্রাহকের সঙ্গে খোলামেলা ও স্বচ্ছ যোগাযোগ নিশ্চিত করা – যেন তারা জানে কেন কোন চার্জ নেওয়া হচ্ছে এবং সেটি শরিয়াভিত্তিক কিনা। অন্যদিকে যেহেতু প্রতিটি ব্যাংকেরই একটি শরিয়া সুপারভাইজারি কমিটি আছে, গ্রাহকগণ তাদের যেকোনো শরিয়া রুলস সম্পর্কিত কোন প্রশ্ন মতামত জিজ্ঞাসা বা অভিযোগ থাকলে বোর্ডে যাতে জানাতে পারেন তার জন্য একটি স্বচ্ছ যোগাযোগ ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।
গ্রাহকদের করণীয় ও বর্জনীয়
গ্রাহকদেরও সচেতন হতে হবে। কেবল ইসলামিক নাম দেখেই কোনো ব্যাংকিং পণ্য গ্রহণ না করে তার পলিসি, চার্জ কাঠামো এবং শরিয়া কমপ্লায়েন্স ভালোভাবে বোঝা উচিত। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ইসলামিক উইং বা শরিয়া স্কলারদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
সংক্ষেপে বলা যায়, ইসলামিক ক্রেডিট কার্ড ব্যবস্থায় উন্নতির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ইসলামিক ব্যাংকিং একটি নৈতিক ও সম্মানজনক অর্থনৈতিক পথ হলেও, এটি টেকসই করতে হলে শরিয়া মেনে চলার পাশাপাশি ব্যবহারকারী বান্ধব ও বাস্তবমুখী সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এতে ইসলামী মূল্যবোধ যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি গ্রাহকের আস্থাও অর্জিত হবে – যা ইসলামিক ফিন্যান্সিং সিস্টেমের পরিপূর্ণতা নিশ্চিত করবে।